আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (২৯ জুন ১৮৬৪ - ২৫ মে ১৯২৪) বাঙালি শিক্ষাবিদ, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষা জাতীয় উদ্দেশ্য লাভে ব্যর্থ হয়। ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন-এ জাতীয় শিক্ষার পরিধি আরও একটু সীমিত হয়ে যায়। কারণ এ আইনের বলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ সরকার মনোনীত ইউরোপীয়দের হাতে চলে যায়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল প্রশাসন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে যে কোন ধরনের জাতীয়তাবাদী আদর্শের অণুপ্রবেশ বন্ধ করা। তাদের আরও চেষ্টা ছিল স্বদেশী বুদ্ধিজীবী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কলেজ সমূহকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অন্তর্ভুক্ত হতে না দেওয়া। ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দারুণভানে উজ্জীবিত করে তোলে। ঠিক এসময়ে সরকারের প্রয়োজন ছিল আশুতোষ মুখার্জীর মতো একজন ব্যক্তিত্ব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপ্রচেষ্টাকে আশুতোষ সমর্থন করেন নি। তার মতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি অ্যাকাডেমিক ঐতিহ্য স্থাপন করেছে যা আমাদের রক্ষা করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত পাশ্চাত্য শিক্ষাকেও জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার চেয়েছিলেন, বিপ্লব চান নি। সরকার অনুভব করেছিল যে, আশুতোষ মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপদ থাকবে, রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোর মধ্যে থেকেই প্রায় সব জাতীয়তাবাদমূলক বিষয়কে কার্যকর করেছিলেন। তিনি কলেজ স্ট্রীট ও রাজাবাজার ক্যাম্পাসে কলা ও বিজ্ঞান শাখার জন্য নতুন বিভাগসমূহ স্থাপন করেন এবং ‘দেশী ভাষা’ ও ‘প্রাচীন ভারতের ইতিহাস’ বিভাগ দুটি চালু করেন। বিদেশী ও ভারতীয় বহু খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ প্রফেসর হিসেবে বিভিন্ন বিভাগে নিযুক্ত হন। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত বিভাগের সিলেবাস প্রণয়নে তত্ত্বাবধান করেন। তিনি ছাত্রদের কল্যাণের জন্য যেমন উদ্বিগ্ন থাকতেন, তেমনি শিক্ষা ও পরীক্ষার ব্যাপারেও তিনি তাদের আগ্রহ সৃষ্টিতে অণুপ্রেরণা দিতেন। তিনি ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো উপাচার্যের পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময়েই তিনি কলা ও বিজ্ঞান শাখার পি.জি. কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হন। ১৮৮৯ সাল থেকেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অণুপ্রেরণা। রাজনীতির সাথে জড়িত না হয়েই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ্চাত্য ও জাতীয় শিক্ষার সুফলগুলি অত্যন্ত সফলতার সাথে সংযু্ক্ত করেন। এভাবে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক রেনেসাঁস ঘটিয়ে ফেলেন। জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় অভিষ্ঠ লক্ষ্যে তাদের কাজকর্মে কোন অংশেই পিছিয়ে ছিলনা। তবে কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অবদান বেশি রাখছিল। তখন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক প্রভাব থাকার কারণে আশুতোষ মুখার্জী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রে সম্পূর্ণ পরিবর্তন সূচিত করতে পারে নি। আশুতোষ মুখার্জী ১৯২৩ সালে কলকাতা হাইকোর্ট ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯২৪ সালের ২৫ মে পাটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।